Sri Krishna Name Explained | Pen 019



শ্রীকৃষ্ণ নামের তাৎপর্য্য 

একটু মনে করে দেখুন তো আমরা যখন মা সরস্বতীকে পূজো করি তখন কি বলে তাঁকে প্রণাম করি ? আমরা করজোড়ে বলি - হে ভদ্রকালী, তোমাকে প্রতিনিয়ত নমস্কার করি। হে সরস্বতী, তোমাকে বারবার নমস্কার করি।  (মা গো) বেদ, বেদাঙ্গ ও বেদান্ত যেন আমার বিদ্যাস্থানে অধিষ্ঠিত থাকে।

ভদ্রকাল্যৈ নম নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ 
বেদ বেদাঙ্গ বেদান্ত বিদ্যাস্থানেভ্য এবচ ।।

এই যে বেদ, বেদাঙ্গ, বেদান্ত - এর সাথে পুরাণ, মহাকাব্য, গীতা, দর্শন, শাস্ত্র ও সিদ্ধান্ত - এই ক'টি কে যোগ করলে একত্রিত ভাবে আমরা তাদের বলি - বৈদিক সাহিত্য। বৈদিক সাহিত্যের প্রায় বারো আনাই কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। সামান্য যেটুকু এখনও বেঁচে আছে তার মধ্যেই রয়েছে বিশাল এক জ্ঞান ভান্ডার এবং তা সংস্কৃত ভাষায় পুঁথির আকারে লিপিবদ্ধ আছে।

ভারতবর্ষের প্রায় সমস্ত ভাষার উৎস সংস্কৃত। অতি প্রাচীন এ ভাষার ব্যাপ্তি ও গরিমা মহাসমুদ্রের মতো। এ ভাষা অতীব বিজ্ঞানসম্মত। যে কারণে এই ভাষাতে অনেক কম শব্দ ব্যবহার করে অনেক বেশী ভাব প্রকাশ করা যায়। এর গঠনশৈলী এতই সুঠাম যে এমনকি কম্পিউটার ব্যবহারের পক্ষেও এ ভাষা অত্যন্ত উপযুক্ত। এ ভাষা এত বেশী ছন্দোবদ্ধ ও সুসংহত যে উপযুক্ত ভাবে মাত্র পনের কুড়ি মিনিট বা আধ ঘণ্টা ধরে এ ভাষার কোন কবিতা বা শ্লোক পাঠ করলে স্নায়ুতন্ত্রের উত্তেজনা প্রশমিত হয়ে মন স্থির হয়ে যায়। এখন আমরা সংস্কৃত ভাষাকে অপাংক্তেয় করে রেখেছি। তাতে কিন্তু এ ভাষার কোন ক্ষতি হয় নি। বরঞ্চ সংস্কৃত ভাষার মধ্যে সংরক্ষিত বিপুল জ্ঞান ভান্ডারের উপযুক্ত ব্যবহার থেকে বঞ্চিত হয়েছি আমরাই। ক্ষতি হয়েছে আমাদেরই।


বৈদিক সাহিত্যের বহু বৈশিষ্ট্য আছে। ভারতবর্ষের অসাধারণ পন্ডিতগণের অসামান্য অবদানের প্রেক্ষিতে শিক্ষা জগতে উপযুক্ত স্থানে এ সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞান লিপিবদ্ধ আছে। এহেন বহু বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিয়ে আজ এখানে আমরা খুব সামান্য একটু আলোচনা করব। এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যটি হল বৈদিক সাহিত্যের নাম রহস্য।

নাম বাচক শব্দকে বলে বিশেষ্য পদ। গোপাল, গোবিন্দ, কৃষ্ণ বা শ্রীকৃষ্ণ ইত্যাদি হল ব্যক্তির নাম। গোলোক একটি বিশেষ স্থানের নাম - যেখানে ভগবান নারায়ণ অধিষ্ঠান করেন। তেমনি বারাণসী একটি জনপদের নাম। হিমালয় একটি পর্বতের নাম। এগুলো সবই নাম বাচক বিশেষ্য পদ।

মজার কথা হল সাধারণ ভাবে সংস্কৃত ভাষায় যাবতীয় নাম বাচক বিশেষ্য পদই কোনও না কোন ক্রিয়া বাচক বা বিশেষণ বাচক পদ থেকে উদ্ভূত অথবা পিতা, মাতা বা স্রষ্টার নাম থেকে উদ্ভূত। অর্থাৎ বৈদিক সাহিত্যের বেশীরভাগ নামের ক্ষেত্রেই কোনও না কোন কারণ ক্রিয়া করে। আর সেই জন্য এই সব নামের পিছনে অবশ্যই কোনও না কোন সমাস কাজ করে। গোদা বাংলায় এর মানে দাঁড়াল এই যে বৈদিক সাহিত্যে উল্লেখিত যে কোন নাম থেকেই তার পরিচয়, গুণ বা বৈশিষ্ট্য জানা যাবে। নাম গুণ বাচক হওয়ার ফলে বৈদিক চরিত্রগণের প্রায় সকলেরই একাধিক নাম - কারণ সকলেরই একাধিক গুণ। একই ব্যক্তি - যখন বাঁশি বা বংশী অথবা মুরলী ধারণ করছেন তখন তাঁর নাম বংশীধর বা মুরলীধর, যখন গিরি ধারণ করছেন তখন তাঁর নাম হল গিরিধারী বা গিরিধর, আবার যখন তিনি চক্র ধারণ করছেন তখন তাঁকে বলছি চক্রধারী বা চক্রধর। সংস্কৃত ভাষার আদি লেখকরা এ ভাবেই এ ভাষার বিন্যাস করেছেন।


আসুন, এবার দু - একটা উদাহরণ নিয়ে একটু খেলা করা যাক। প্রথম যে নামটা লিখেছি তা হল গোপাল। এটা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাল্যবেলার নাম। ওপরের বক্তব্য অনুসারে গোপাল নাম থেকেই নামধারীর পরিচয় জানা সম্ভব। তাহলে গোপাল মানে কি ? আমরা সবাই জানি গো মানে গোরু আর পাল মানে দল বা দঙ্গল। অর্থাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাল্যবেলার নাম গোরুর পাল বা গোরুর দল। কিন্তু না, এটা গোপাল শব্দের সঠিক মানে নয়। এটা নিতান্তই একটা বাংলা ভাষার লঘু বিন্যাস। গোপাল আসলে একটি সংস্কৃত শব্দ এবং সংস্কৃত ভাষায় এর সমাস হল - পালয়তে গো ইতি গোপাল। অর্থাৎ গোরু পালন করেন যিনি - তিনি হলেন গোপাল বা রাখাল। এই মানেটা অনেকটা কাছাকাছি গেছে কিন্তু সবটা নয়। সংস্কৃত সাহিত্যে আমরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে গোপালক বা রাখাল হিসাবেই দেখতে পাই। ভারতবর্ষের ভক্তিমান সাধারণ আমজনতা এবং বহু পন্ডিত ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে গোপাল অর্থে গোপালক বা রাখাল হিসাবেই দেখেন এবং তাঁকে রাখালরাজা বলে ডাকেন।

কিন্তু এর পরেও গোপাল নামের আর একটা মানে আছে। তবে সেই মানেটা বুঝতে গেলে অন্য আরেকটা বিষয় জানতে হবে। এ লেখার প্রথমেই যে তিনটি শাস্ত্রের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা হল বেদ, বেদাঙ্গ ও বেদান্ত। তার মধ্যে বেদাঙ্গ হল - শিক্ষা, কল্প, নিরুক্ত, ছন্দ, ব্যাকরণ, ও জ্যোতিষ - এই ছয়টি বিশেষ শাস্ত্রের সমাহার। তার মধ্যে এখন আমরা যে শাস্ত্রের শরণ নিতে চাই তা হল নিরুক্ত। মহাপন্ডিত যাস্ক এর প্রণেতা। নিঃশেষ রূপে উক্ত হয়েছে বা বলা হয়েছে - তাই এ শাস্ত্রকে বলে নিরুক্ত। নিরুক্ত শাস্ত্রে ধাতুরূপ, শব্দরূপ এবং তার প্রয়োগ বিষয়ে বিশেষ আলোচনা আছে। অর্থাৎ একই ধাতু বা শব্দের কত রকম মানে হতে পারে তা এই শাস্ত্র থেকে জানা যায়। ইংরেজিতে একে বলে Etymology.


নিরুক্ত অনুযায়ী গো শব্দের একাধিক মানে। তার মধ্যে একটি মানে অবশ্যই গোরু কিন্তু আরেকটি মানে হল জ্যোতিঃ। অর্থাৎ সংস্কৃত সমাস - পালয়তে গো ইতি গোপাল অনুযায়ী গোপাল শব্দের গভীরতর অর্থ দাঁড়াল যিনি জ্যোতি পালন করেন তিনিই হলেন গোপাল - অর্থাৎ জ্যোতির্ময়। তেমনই বিন্দ শব্দের মানে হল ভ্রুমধ্য। যাঁর বিন্দ এ (ভ্রুমধ্যে) গো (জ্যোতি) বিরাজমান তিনি হলেন গোবিন্দ। অর্থাৎ - যিনি সদা জ্যোতির্দর্শন করেন তিনিই গোবিন্দ। গোদা বাংলায় যদি গোলোক মানে বলি গোরুর খাটাল তাহলে খুব ভুল কিছু বলা হয় না। কিন্তু ভগবান নারায়ণ গোলোকে অধিষ্ঠান করেন বললে বুঝতে হবে আসলে তিনি জ্যোতির্লোকে অধিষ্ঠান করেন।

বৈদিক সাহিত্যের প্রায় সব নামই এই রকম রহস্যময়। উপযুক্ত ভাবে বিশ্লেষণ না করতে পারলে নামের মানে পরিস্কার হয় না। এবার আরেকটি নামের মানে বিশ্লেষণ করে আজকের আলোচনা শেষ করব। এই বিশেষ নামটি হল কৃষ্ণ বা শ্রীকৃষ্ণ। বৈদিক সাহিত্যের অন্যতম আকর গ্রন্থ মহাভারত মহাকাব্যে দুজন শ্রীকৃষ্ণ আছেন। একজন হলেন মহামুনি পরাশর পুত্র শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস। ইনি বেদ বিন্যাস কর্ত্তা। মহাভারত, পুরাণ ও দর্শন সহ একাধিক গ্রন্থের রচয়িতা। আর একজন হলেন মহাভারতের মহানায়ক - বন্দী রাজা বসুদেব ও তাঁর স্ত্রী দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান - ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।

আমরা জানি সংস্কৃত এবং বাংলা - দুই ভাষাতেই শ্রী মানে সুন্দর, সুষমা, ঐশ্বর্য ইত্যাদি এবং কৃষ্ণ শব্দের সাধারণ মানে কালো। অতএব শ্রীকৃষ্ণ মানে সুন্দর কালো। যদিও ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে আদর করে কেউ কেউ কালো মাণিক বলে ডাকেন কিন্তু জাস্ট সুন্দর কালো মাণিক বলবার জন্য নাম রাখা হল শ্রীকৃষ্ণ - এটা কি খুব বিশ্বাসযোগ্য ? মোটেই না।


সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুযায়ী কৃষ্ণ শব্দের প্রত্যয়গত বিন্যাস হল - কৃষ্ (ধাতু) + নঃ = কৃষ্ণ। কৃষ্ ধাতুর অর্থ আকর্ষণ করা এবং নঃ শব্দের অর্থ আমাদিগকে। তাহলে মানেটা কি দাঁড়াল ? যিনি আমাদের আকর্ষণ করেন তিনিই হলেন কৃষ্ণ। তা তো বটেই। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সুন্দর এবং আমরা অনেকেই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট তো হয়েই আছি। কিন্তু ভেবে দেখুন তো বেদব্যাস শ্রীকৃষ্ণের বেলায় কথাটা কি খাটে ? না - খাটে না। কেন খাটে না ? কেন না আরও একটা বিশেষ এবং অধিকতর গভীর মানে আছে এ শব্দের। এবং সেই মানেটা দুজনের জন্যই খাটে।

নিরুক্ত অনুযায়ী কৃষ্ ধাতুর আরেকটি অর্থ হল কর্ষণ করা এবং ন একটি না সূচক বা রহিত সূচক শব্দ। কর্ষণ এর দুটি প্রকার - আকর্ষণ ও বিকর্ষণ যা আমাদের মানব দেহে শ্বাস ও প্রশ্বাস রূপে আজন্মমৃত্যু সততঃ বিরাজমান। অর্থাৎ শ্বাস (আকর্ষণ) ও প্রশ্বাস (বিকর্ষণ) রূপ কর্ষণ রহিত অবস্থায় বা কৈবল্য অবস্থায় যিনি থাকেন তিনিই কৃষ্ণ। এখন দেখা যাক শ্রী শব্দের মানে কি। শ্রী শব্দে তিনটি অক্ষর - শ্ , র এবং ঈ। শ্ অর্থে আত্মা বা প্রাণ, র অর্থে রমণ এবং ঈ অর্থে শক্তি। অর্থাৎ কিনা প্রাণ রমণ করে বা প্রাণায়াম করে প্রাপ্ত শক্তির অধিকারী হলেন শ্রী। তাহলে শ্রীকৃষ্ণ শব্দের অর্থ শেষকালে কি দাঁড়াল ? যিনি প্রাণায়াম প্রাপ্ত শক্তির দ্বারা শ্বাস ও প্রশ্বাস রূপ কর্ষণ রহিত অবস্থায় বা কৈবল্য অবস্থায় সদা বিরাজমান থাকেন - তিনিই হলেন শ্রীকৃষ্ণ। জয় শ্রীকৃষ্ণ ।। 


Please Subscribe and Share

Comments

Post a Comment

Popular Posts