Amarkantak | Pen 023
(দ্বিতীয় কিস্তি)
অমরকন্টক যাব তো নাহয় বললাম কিন্তু প্রথম কথা হল যাব কি করে ? গাড়িতে না ট্রেনে ? গাড়িতে গেলে কোন পথে যাব ? আর ট্রেনে গেলেই বা কি করে যাব ?
আমাদের এদিকের - মানে হুগলি, কলকাতা বা দক্ষিণ বঙ্গের যে সমস্ত লোক অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় তাঁরা গাড়ি নিয়ে অমরকন্টক যাবার কথা ভাবতে পারেন। গাড়ি নিয়ে গেলে একটা রাস্তা আছে রাঁচি অম্বিকাপুর হয়ে - আর একটা রাস্তা একটু ঘুরে ধোবি ডাল্টনগঞ্জ হয়ে। পথের দূরত্ব অম্বিকাপুর হয়ে ৯০০ কিলোমিটার আর ডাল্টনগঞ্জ হয়ে ৯৫০ কিলোমিটার।
অবশ্য এর মধ্যে একটা কথা আছে। যাঁরা গাড়ি নিয়ে যাবেন তাঁরা তো শুধু অমরকন্টক যাবার জন্য গাড়ি বের করবেন না। একই তেল খরচ করে অনেক বেশী দর্শনীয় স্থান দেখার উদ্দেশ্য তাঁদের থাকবেই। যদি তাই হয় তবে আমার মতে একটা ভালো রুট হল মুম্বাই রোড ধরে সম্বলপুর বিলাসপুর হয়ে অমরকন্টক দেখে নিয়ে মান্ডলা জবলপুর খাজুরাহো বারাণসী হয়ে জি টি রোড ধরে কলকাতা ফিরে আসা। এই রুটে রুচি ও চাহিদা অনুযায়ী মোট ২৫০০ থেকে ৩০০০ কিলোমিটার জার্নি হয়ে যাবে কিন্তু একসাথে আপনার অনেক কিছু দেখা হয়ে যাবে।
কিন্তু যাঁরা গাড়িতে যাবার ধকল নিতে চান না বরঞ্চ ট্রেনে শুয়ে যেতেই ভালোবাসেন তাঁরা কি করবেন ? তাঁরা কলকাতা থেকে ট্রেনে বিলাসপুর, পেনড্রা রোড কিংবা অনুপপুর - এই তিনটের মধ্যে যে কোন একটা ষ্টেশনে নেমে বাস বা গাড়িতে যেতে পারেন। অমরকন্টক থেকে বিলাসপুর, অনুপপুর ও পেনড্রা রোড এর দূরত্ব যথাক্রমে ১৩০, ৭০ ও ৩৫ কিলোমিটার। হাওড়া থেকে পেনড্রা রোড বা অনুপপুর যাওয়ার কোন ডাইরেক্ট ট্রেন নেই কিন্তু বিলাসপুর এর ডাইরেক্ট ট্রেন আছে। প্রতিদিন চলে এরকম ট্রেন আছে চারটে - আহমেদাবাদ মেল, মুম্বাই মেল, গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেস ও আজাদ হিন্দ এক্সপ্রেস। এছাড়া আরো অনেক ট্রেন আছে কিন্তু সেগুলো রোজ চলে না।
ডাইরেক্ট পেনড্রা রোড বা অনুপপুর যাওয়ার ট্রেন হাওড়া থেকে ছাড়ে না - ছাড়ে শালিমার থেকে। অর্থাৎ শালিমার বা সাঁতরাগাছি ষ্টেশন থেকে এইসব ট্রেন ধরতে হবে। এই রকম ট্রেন আছে তিনটে - প্রত্যেকটি সপ্তাহে একদিন করে চলে। শনিবার ভুজ এক্সপ্রেস, রবিবার উদয়পুর এক্সপ্রেস এবং সোমবার জয়পুর এক্সপ্রেস। এখানে মনে রাখতে হবে শনিবারের ট্রেন ভুজ এক্সপ্রেস পেনড্রা রোডে দাঁড়ায় না। বিলাসপুর ছেড়ে সোজা অনুপপুরে গিয়ে দাঁড়ায়।
২০১৬। মার্চ মাসের মাঝামাঝি। তপোভূমি নর্মদা প্রায় শেষ করে এনেছি। জানুয়ারী তে শুরু করেছিলাম, এখন ন'শো পাতার মধ্যে আর হয়তো শ' খানেক পাতা বাকি আছে। বিষয়বস্তু ও বর্ণনার গুণে এতটাই মুগ্ধ হয়ে আছি যে আমি বইটা খেয়ে নিচ্ছি না বইটা আমায় খেয়ে নিচ্ছে তা বুঝতে পারছি না।
নদী তো নদীই হয় - জল বয়ে যায় - জীবন গড়ে যায়। কিন্তু গঙ্গা ছাড়া আর কোন নদীর যে আধ্যাত্মিক মাহাত্ম্য থাকতে পারে তা আমার জানা ছিল না। সগর রাজার ষাট হাজার অভিশপ্ত পুত্রকে উদ্ধার করার জন্য তাঁরই বংশধর ভগীরথের সাধনায় তুষ্ট হয়ে মা গঙ্গা স্বর্গ থেকে মর্ত্যে এসেছিলেন। আসার পথে গঙ্গা প্রবল বেগে প্রথমে এলেন শিবের জটায়। সেখানে তাঁর বেগ কমল। তারপর উনি প্লাবিত করলেন জহ্নু মুনির আশ্রম। ক্রুদ্ধ জহ্নু গঙ্গাকে পান করে নিলেন। অতঃপর ভগীরথের অনুরোধে জহ্নু মুনি তাঁর জানু চিড়ে গঙ্গাকে বার করে দিলেন। এরপর ভগীরথ গঙ্গাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসেন বাংলার সাগরের কাছে কপিল মুনির আশ্রমে এবং সেইখানে সেই ষাট হাজার মৃত পুত্রকে গঙ্গা স্পর্শ করিয়ে পুনর্জীবিত করেন। জহ্নুর জানু থেকে নির্গত হওয়ার জন্য গঙ্গার আরেক নাম হল জাহ্নবী এবং ভগীরথের অনুসরণ করার জন্য গঙ্গার আরেক নাম হল ভাগীরথী।
এই হল মা গঙ্গার মর্ত্যে আগমন জনিত পৌরাণিক গল্প। কিন্তু আমার মতে এই গল্পটা একটা ইরিগেশন প্রোজেক্ট এর ডকুমেন্টেশন। স্বর্গ - মানে হিমালয়ের সু-উচ্চ কোন পর্বতের মাথায় অবস্থিত কোন গ্লেসিয়ার থেকে বিশাল একটা বরফের চাঁই অনেক নীচে মাটিতে পড়ে সেই মাটিকে ফাটিয়ে চৌচির করে দিল। সেই হাজার ফাট এর মধ্যে ঘুরপাক খেতে খেতে জলের বেগ কমে গেল। ওই হাজার ফাট মাটিটা হল শিবের জটা। তারপর সব জল এসে পড়ল পাহাড়ের কোলে অবস্থিত বিরাট একটা বদ্ধ খাদের মধ্যে। এই ন্যাচারাল ড্যাম এর মধ্যে পড়ে জলের প্রবাহ হারিয়ে গেল। এটাই হল জহ্নু মুনি। তারপর সেই ন্যাচারাল ড্যাম এর মাথা থেকে পুরো উচ্চতার দুই তৃতীয়াংশ নীচে (মানে জানুতে) একটা ফুটো হল এবং সেই ফুটো দিয়ে জল বেরিয়ে গেল। জলের ইঞ্জিনিয়ারিং যাঁরা জানেন তাঁরা বুঝবেন যে ওখান থেকেই জল বের হবার কথা। এরপর ভগীরথ খাল কাটতে কাটতে এলেন সাগরে। গঙ্গা মা ও এলেন আরামসে। আমার তো মনে হয় ভগীরথ ই ভারতের প্রথম ইরিগেশন ইঞ্জিনীয়ার।
তা সে যাই হোক, মা গঙ্গার কথা রেখে আসুন আবার আমরা মা নর্মদার কথায় ফিরে আসি। তপোভূমি নর্মদা বই পড়ে এতক্ষণে আমি মা নর্মদার আধ্যাত্মিক মাহাত্ম্য ও মহিমা অনেকটাই জেনে গেছি। আমি জেনে গেছি মা নর্মদা ভারতের পবিত্রতম নদী। স্কন্দ পুরাণ এর অন্তর্গত রেবা খন্ড অংশে বর্ণিত আছে দেবাদিদেব মহাদেবের রুদ্র তেজ হতে মা নর্মদার জন্ম। এ জগতের স্থাবর জঙ্গম সমস্ত কিছুকেই ইনি ত্রাণ করেন।
নর্মদা সরিতাং শ্রেষ্ঠা রুদ্রতেজাৎ বিনিঃসৃতা
তারয়েৎ সর্বভূতানি স্থাবরানি চরানি চ ।।
তারয়েৎ সর্বভূতানি স্থাবরানি চরানি চ ।।
স্বর্গ মর্ত্য ও পাতালের সকলকে ইনি নর্ম বা আনন্দ দান করেন। তাই ইনি নর্মদাত্রী বা নর্মদা। উত্তরে বিন্ধ্য এবং দক্ষিণে সাতপুরা - এই দুই পর্বতমালার মধ্যে দিয়ে মা আনন্দে কলরব বা রব করতে করতে বয়ে যান - তাই মা নর্মদার আরেক নাম রেবা।
আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাসী এবং ভক্তিবাদীদের মতে ইনি এতটাই পূণ্যসলিলা যে স্বয়ং মা গঙ্গাও বছরে এক বার এই নদীতে অবগাহন করে নিজের পাপ মোচন করে যান। কিন্তু মা গঙ্গা কি পাপী ? না, মা গঙ্গা নিজে পাপী নন। মর্ত্যের মানুষ তাদের পাপ গঙ্গার জলে প্রক্ষালন করে মা গঙ্গাকে পাপী করে তোলে।
মা নর্মদাকে দর্শন করার জন্য মন তখন খুবই ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। এবং আমার মন চাইছে যে আমি একাই সেখানে যাই। আমার বাসনার কথা বাড়িতে স্ত্রী কে বলাতে তিনি আনন্দ সহকারেই সম্মতি দিলেন কিন্তু একটা শর্ত জুড়ে দিলেন। শর্তটা হচ্ছে এই যে আমার একা যাওয়া হবে না। একটা সঙ্গী নিতে হবে। বয়স হয়েছে। কোথায় কি হয় কিছুই বলা যায় না। তাছাড়া একাকীত্ব এক চরম শাস্তি। একটা সঙ্গী থাকা মানে একাকীত্বের শাস্তি থেকে মুক্তি। অতএব শানু কে সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। শানু আমার ছাত্র। আমাদের জন্য অনেক করে। আমার একা যাবারই ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বাধ্য হয়ে শানু কে স্বীকার করলাম।
(ক্রমশঃ)
Please share and subscribe
খুব সুন্দর। পরের অধ্যায় পড়ার জন্য অপেক্ষায় থাকলাম।
ReplyDeleteThank you ...
DeleteWell done
ReplyDeletedarun laglo sir .anek kichu sikhlam sir, khub khub valo legeche.
ReplyDeleteThank you. Please wait for many more things to come.
Deleteস্যার খুব ভালো লাগলো পড়ে । এরকম আরো লিখবেন ।
Delete