Amarkantak | Pen 024
(তৃতীয় কিস্তি)
রবিবার ৩ রা এপ্রিল, ২০১৬। সকাল নটা। বিলাসপুর ছেড়ে ট্রেন বেশ কিছুটা এগিয়ে এসেছে। একটু লেটেই চলছে। আমি আর শানু গতকাল রাত সাড়ে আটটায় সাঁতরাগাছি থেকে ভুজ এক্সপ্রেস ধরেছি। এটা পেনড্রা রোডে দাঁড়াবে না। সোজা গিয়ে দাঁড়াবে অনুপপুরে। আমরা সেখান থেকে যাহোক একটা গাড়ি ভাড়া করে নেব। অনুপপুর থেকে অমরকন্টক যাবার বাস আছে বটে তবে সে বাস কখন ছাড়ে জানি না।
ট্রেন এখন পুরো পাহাড়ের ওপর দিয়ে চলছে। এখানে বেশ ভালোই চড়াই। পাহাড় কেটে পথ তৈরী করে রেল লাইন বসাতে হয়েছে। চার দিকে ঘন বন। অমরকন্টক বনাঞ্চল। বনের গাছ কম বেশী সবই প্রায় শাল। আমি ক্যামেরা নিয়ে জানলার কাছে বসে আছি আর মাঝে মাঝে ছবি তুলছি।
হঠাৎ প্যাঁ প্যাঁ করতে করতে ট্রেনটা দাঁড়িয়ে গেল। দু তিন মিনিট পরেই দেখলাম বিভিন্ন বগি থেকে অনেক লোক নীচে নেমে গেল। তাই দেখে শানু এবং আমিও নামলাম। আমি দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে রইলাম। শানু এগিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর ও খবর নিয়ে এল এই ট্রেনে একটা লোক কাটা পড়েছে। ট্রেন লোকটাকে কাটেনি - লোকটাই ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এটা শুনেই বুকের ভেতরটা হঠাৎ ধ্বক্ করে উঠলো। জীবন মরণের মাঝে তাহলে কি এই এক চিলতেই ফাঁক ? পাঁচ মিনিট আগেও লোকটা বেঁচে ছিল আর পাঁচ মিনিট পরেই আর নেই। মনটা বিষাদে ভরে গেল। মনে মনে লোকটা কে বলতে লাগলাম - কি রে বাবা, ঝাঁপালি কেন ? বৌ এর সঙ্গে ঝগড়া নাকি সংসারে অভাব ? আর যুঝতে পারলি না ?
প্রায় আধঘণ্টা পর ট্রেন ছাড়ল। বেলা বারোটা বেজে গেল অনুপপুর পৌঁছাতে। ষ্টেশনের বাইরে গোটা দশ বারো গাড়ি দাঁড়িয়েছিল - কেউ ১৩০০ কেউ ১৪০০ দর হাঁকল অমরকন্টক যেতে। শেষ পর্যন্ত্য দরাদরি করে শানু ১২০০ টাকায় একটা বলেরো গাড়ি ভাড়া করল। কম দামে গাড়ি পেলাম বলে মনটা ভালো হবার কথা। কিন্তু আমার মনে আবার অন্য একটা ভাবনা ক্রিয়া করতে লাগলো। এই দশ বারোটা গাড়ির মধ্যে একটাই তো একটা ভাড়া পেল - আমাদেরকে। অমরকন্টক যাবার আর কোন লোক তো দেখলাম না। তাহলে বাকি গাড়িগুলো ভাড়া কখন পাবে ? দিনে একটাও ভাড়া না পেলে ওদেরই বা চলবে কি করে ? এক ঝলকে চারদিক দেখে যা মনে হল অনুপপুর জায়গাটা তেমন জমজমাট বাজার তো নয়।
এখন আমাদের দুজনেরই বেশ ক্ষিদে পেয়েছে। সেই সকাল থেকে ভালো করে কিছু খাওয়া হয় নি। তাই গাড়ি নিয়ে প্রথমেই একটা খাবারের দোকানে গেলাম। পেট ভরে পুরি সবজি আর এক গ্লাস করে ঘন দুধের চা খেলাম। তারপর সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে ড্রাইভারকে বললাম চল।
মহাভারতের গল্পে দেখি দুই পক্ষের যুদ্ধ। দুর্যোধনের নেতৃত্বে কৌরব পক্ষ, যুধিষ্ঠিরের নেতৃত্বে পান্ডব পক্ষ। পান্ডব পক্ষের কুল পুরোহিতের নাম ধৌম্য মুনি। কপট পাশা খেলায় দুর্যোধনের কাছে সর্বস্বান্ত হয়ে যুধিষ্ঠির যখন মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত তখন সান্ত্বনা দেবার জন্য ধৌম্য পুরোহিত এসে যুধিষ্ঠির কে ভ্রমণ করার উপদেশ দিলেন। বেড়াতে গেলে কি রকম মানসিক উপকার হয় ও কত রকম পূণ্য অর্জন হয় সে সম্পর্কে বললেন। ওদিকে আবার পুলস্ত্য মুনি কোথাও থেকে খবর পেয়ে এসে যুধিষ্ঠির কে ডেকে বললেন - শোন যুধিষ্ঠির, পৃথিবীর যে কোন জায়গার থেকে ত্রিলোক প্রসিদ্ধ নর্মদা নদীর তীরে ভ্রমণ করলে এবং নর্মদায় তর্পণ করলে অনেক বেশি পূণ্য অর্জন হয়। অগ্নিষ্টোম যজ্ঞের ফল লাভ হয়। সুতরাং যথাশীঘ্র সম্ভব তুমি নর্মদা মা কে দর্শন কোর।
অনুপপুরে যতক্ষণ ছিলাম খুব গরম লাগছিলো। এখন গাড়ি পাহাড়ের পাদদেশ ছাড়িয়ে আস্তে আস্তে ওপরে উঠতে শুরু করেছে। এর মধ্যেই বেশ আরাম লাগতে শুরু করেছে। তাপমাত্রা কমছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে। মেকল পাহাড়ের চড়াই শুরু হবার মুখে রাস্তার ধারে একটা আশ্রমে এসে গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। ড্রাইভার বলল - দেখ লিজিয়ে সাহাব, ইয়ে হ্যায় বড়া সাধু লালজী বাবা কা আশ্রম।
গাড়ি থেকে নেমে ধীর পায়ে লালজী বাবার আশ্রমে গেলাম। বর্ণনা করার মত আহামরি কিছু নয়। একটা ঘর। ঘরের সামনে তিন দিক ঘেরা বড় একটা বারান্দা আর তার পরেই একটা বড় চাতাল। চার দিক খোলা, শুধু মাথার ওপর ছাদ। পুরো চাতাল জুড়ে পূজো করার জন্য বিভিন্ন রকম পাথরের মূর্তি রাখা আছে। তারমধ্যে একটা মূর্তি হল পঞ্চমুখী হনুমানের। এমন মূর্তি আমি আগে কখনও দেখিনি। বারান্দায় একটা চটের ওপর লালজী বাবা একা বসে আছেন। গেরুয়া বসন। নির্বাক ও অপলক। আমি গিয়ে পা ছুঁয়ে প্রণাম করলাম। বললাম বাংলা থেকে আসছি, অমরকন্টক যাচ্ছি। সাধু বাবা প্রসন্ন মুখে হাসলেন। প্রসাদ দিলেন এক টুকরো নারকেল ও কিছুটা নকুল দানা। সুযোগ বুঝে আলাপ করার চেষ্টা করলাম। কোন লাভ হল না। উনি নির্বাক হয়ে বসে রইলেন। কিন্তু আসার সময় যখন অনুমতি চাইলাম তখন স্মিত হেসে আশীর্বাদের ভঙ্গীতে হাত তুলে বললেন - কল্যাণ হো।
সংস্কৃত সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি কালিদাস তাঁর মেঘদূত কাব্য গ্রন্থে মেঘকে উদ্দেশ করে বলেছেন - ওগো মেঘ, যেতে যেতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে তুমি আম্রকূট পাহাড়ের মাথায় বিশ্রাম নিও, সেখানকার ঘন সবুজ ও সুশীতল অরণ্যে তুমি শান্তি পাবে। কালিদাস যাকে আম্রকূট পাহাড় বলে উল্লেখ করেছেন সেটাই আজকের মেকল বা মেখল পাহাড়। এর সর্বোচ্চ উচ্চতা প্রায় ১,০৫০ মিটার বা ৩,৫০০ ফুট। এখন সেই পাহাড়ের গা বেয়ে চলছে আমাদের গাড়ি। পথের দৃশ্য অসাধারণ। শাল, পলাশ, গরান, পাইন, চীর ছাড়াও আরো কত রকমের যে গাছ ! চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। স্থানীয় ভাষায় বলে হরিয়ালি। বাংলার মানুষ আমি। কচি ধানের ক্ষেতের দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ দেখতে অভ্যস্ত। কিন্তু এখানে কত রকমের সবুজ ! একেকটা একেক রকম। ভাষা দিয়ে এর প্রকাশ হয় না। নিজের চোখেই দেখতে হয়। নিজের চোখে না দেখলে প্রকৃতির আশীর্বাদের উপলব্ধিটাই হয় না। এটাই হল ভ্রমণের মাহাত্ম্য !
ধ্যানমগ্ন নিস্তব্ধ প্রকৃতি আর স্নিগ্ধ সবুজের সমারোহ সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে করতে বেলা দুটো নাগাদ আমরা অমরকন্টক পৌঁছালাম। ঘর নিলাম সর্বোদয় হোটেলে। অমরকন্টকে হোটেল বোধহয় এই একটাই - আর বাকি সব আশ্রম। আরও কিছু থাকার জায়গা অবশ্য আছে। সরকারি গেষ্ট হাউস। অনুপপুরের পুরি সবজি কববে হজম হয়ে গেছে। ঘরে ব্যাগ রেখে কোনক্রমে মাথায় একটু জল ঢেলেই ছুটলাম ডাইনিং হলের দিকে। হরি হে গোবিন্দ - পেট ভরলেই আনন্দ।
Comments
Post a Comment