Amarkantak | Pen 025



(চতুর্থ কিস্তি)

সমুদ্র মন্থন কালে অমৃতের আগে উঠল বিষ - ভয়ঙ্কর বিষ। সেই বিষের বাষ্পে ধরাতল শুকিয়ে যাওয়ার অবস্থা হল। এই অবস্থা থেকে ধরণীকে রক্ষা করতে এগিয়ে এলেন ত্র্যম্বকেশ্বর শিব। সেই বিষ তিনি স্বয়ং পান করলেন - কিন্তু এমন ভাবে করলেন যে হলাহল তাঁর গলাতেই রয়ে গেল। গলার নীচে আর নামল না। সেই বিষের প্রভাবে দেবাদিদেব মহাদেবের কন্ঠ নীল হয়ে গেল। সেই থেকে প্রভূ মহেশ্বরের আরেক নাম হল নীলকন্ঠ। এবং বিষের প্রভাবেও অক্ষত থেকে যাবার জন্য তাঁর কন্ঠের নাম হল অমরকন্ঠ। এই অমরকন্ঠ শব্দ থেকেই এসেছে অমরকন্টক।

কিন্তু বিষের প্রভাবে প্রভূ মৃত্যুঞ্জয়েরও তো কষ্ট হচ্ছে। এবং সেই কষ্ট থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য প্রাণায়াম করতে বসেছেন প্রভূ মহাদেব - এই মেকল পর্বতের চূড়ায়। প্রাণায়ামের পরিশ্রমের ফলে তাঁর নীলকন্ঠে তৈরী হল এক বিন্দু ঘাম এবং ঝরে পড়ল তাঁর ডান উরুতে। সেই ঘাম থেকে সৃষ্টি হল এক শ্যাম বরণী দেবী কন্যা। অনেক দিন পর ধ্যান ভেঙ্গে কিশোরী সেই কন্যাকে দেখে শিব জিজ্ঞেস করলেন - কে তুমি মা ? মেয়েটি বলল - হে পিতা ! আমি আপনারই কন্যা। আপনার অমরকন্ঠ থেকে উদ্ভূত ঘাম থেকে আমার সৃষ্টি। এখন আমার কর্তব্য ও কর্ম সম্পর্কে আমায় নির্দেশ দিন।


আদিদেব বললেন - মা, তুমি দর্শনেই আমাকে আনন্দ বা নর্ম দান করেছ। তাই আজ থেকে তোমার নাম নর্মদা। এই ত্রিলোকে তুমি অমর হবে এবং এ ধরণীর স্থাবর জঙ্গম সকলকেই তুমি ত্রাণ করবে। তোমার দর্শনেই সবার সব পাপ মোচন হবে। তুমি আমার দিকে মুখ করে পশ্চিম মুখে দাঁড়িয়ে আছ। এখন তুমি পূণ্য সলিলা নদী হয়ে সম্মুখে বয়ে যাও - যতক্ষণ না সমুদ্র পাও। তোমার জল এ ধরণীর পবিত্রতম জল হবে। কন্যা বলল - তাই হবে পিতা। কিন্তু আমার মনের বাসনা এই যে আমি যেন কখনও আপনার সঙ্গচ্যূত না হই। শিব বললেন - তথাস্তু, এখন থেকে তোমার বুকে সর্বত্র আমি শিবলিঙ্গ হয়ে বিরাজ করব। সেই জন্যেই বলে নর্মদার তীরে প্রতিটি পাথরই শিব - নর্মদা মে হর কংকর হি শংকর হ্যায়। সেই জন্যেই নর্মদার উৎপত্তি থেকে সঙ্গম পর্যন্ত্য একের পর এক বিখ্যাত ও অবিখ্যাত শত শত শিবমন্দির ও শিবতীর্থ। এই মন্দির গুলির মধ্যে খুবই উল্লেখযোগ্য দু একটি মন্দির হল মামলেশ্বর, মহেশ্বর, ওঁকারেশ্বর ইত্যাদি। সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত্য ভারতে এমন কোন মহাত্মা নেই যিনি কোন না কোন সময় অন্তত এক বারের জন্য হলেও নর্মদার তীরে ভ্রমণ, সাধন বা বাস করেন নি।

নর্মদা পরিক্রমা অতি প্রাচীন কাল থেকে হিন্দুদের কাছে এক অতি পবিত্র সাধনা হিসাবে গণ্য করা হয়। মা নর্মদার উৎস স্থল থেকে যাত্রা শুরু করে নদীকে সর্বদা দক্ষিণে অর্থাৎ ডান দিকে রেখে মোহনা পর্যন্ত্য গিয়ে সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে নৌকায় মোহনা অতিক্রম করে আবার মোহনা থেকে উৎসে ফিরে আসাকে বলে নর্মদা পরিক্রমা। অর্থাৎ মা নর্মদার দক্ষিণ তট ধরে গিয়ে উত্তর তট দিয়ে ফিরে আসতে হয়। অনেক কষ্ট করে কঠিন সব নিয়ম কানুন এবং সংযম পালন করে পায়ে হেঁটেই এই পরিক্রমা করতে হয়। নর্মদার দৈর্ঘ্য ৮১৩ মাইল বা ১,৩০০ কিলোমিটার। অর্থাৎ যাতায়াতে প্রায় ২,৭০০ - ২,৮০০ কিলোমিটার হাঁটতে হয়। নদীর দুই তীরের বাসিন্দারা এইসব ভ্রমণকারীদের অত্যন্ত ভক্তি ও সম্মান এর সাথে পরিক্রমাবাসী বলে সম্বোধন করেন এবং সব রকম সাহায্য করেন। তপোভূমি নর্মদার লেখক মহা বেদজ্ঞ পন্ডিত শ্রীযুক্ত শৈলেন্দ্র নারায়ণ ঘোষাল শাস্ত্রীজী ছ' বছর সময় নিয়েছিলেন এই পরিক্রমা করতে। এখনও বহু ভক্ত পদব্রজে এই পরিক্রমা করেন।

আজকাল অবশ্য একটু স্বচ্ছল ভক্তদের জন্য নতুন পদ্ধতি চালু হয়েছে - গাড়িতে পরিক্রমা। গাড়িতে গেলে রাস্তা একটু বেশি পড়ে - প্রায় ৩,০০০ - ৩,১০০ কিলোমিটার কিন্তু তা হলেও দিন কুড়ির মধ্যেই সফল ভাবে করে ফেলা যায় এই পরিক্রমা। এখন অনেক সুবিধা হয়েছে। সাহায্য করার জন্য অনেক জায়গায় অনেক সংস্থা তৈরী হয়েছে। তবে পরিক্রমা করুন বা নাই করুন - মা নর্মদার প্রতি আপনার ভক্তি থাকলে তাঁর আশীর্বাদ আপনি ঠিকই বুঝতে পারবেন।


অমরকন্টক যে শুধু মাত্র মা নর্মদার উৎস স্থল হিসাবে বিখ্যাত - তা কিন্তু নয়। আরো একটি বিখ্যাত নদের উৎপত্তি এই অমরকন্টকে। সেই নদ এর নাম শোন। এটি গঙ্গার একটি উপনদ। প্রায় ৫০০ মাইল বা ৮০০ কিলোমিটার লম্বা। প্রাচীন কালে এর গালভরা নাম ছিল হিরণ্যবাহ। অমরকন্টকে শোনমুড়া বলে একটা জায়গা আছে। সেটাই হল শোন নদীর উৎপত্তি স্থল।ধরণীর গর্ভ থেকে উৎসারিত হয়েই শোন প্রায় ১০০০ ফুট ঝাঁপিয়ে পড়ছে নীচে। তারপর মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, ঝাড়খণ্ড হয়ে বিহারের পাটনার কাছে গঙ্গায় মিলিত হয়েছে।

দুপুর বেলায় খেয়ে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। শানুর ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো। উঠে দেখি প্রায় পাঁচটা বাজে। রুম সার্ভিসে দু কাপ চা আনিয়ে খেয়ে দুজনে মিলে বের হলাম মা নর্মদার মন্দির দর্শন করতে। হোটেল থেকে মিনিট পাঁচেকের হাঁটা পথ।

মন্দির না বলে একে মন্দির কমপ্লেক্স বলাই ভাল। বিশাল এক চত্বর। অন্তত দেড় দু বিঘে জমি হবে। পুরোটা উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। ভেতরের মেঝে সাদা পাথরে বাঁধানো। চত্বরের ঠিক মাঝখানে মা নর্মদার উদ্গমএবং উদ্গম এর ওপরে একটা মাঝারি মাপের মন্দির। এখানেই মাটির নীচে থেকে চুঁইয়ে আসছে জল এবং প্রথমেই পড়ছে একটা শিবলিঙ্গের মাথায়। তারপর সেই জল জমা হচ্ছে এগার কোন বিশিষ্ট একটি কুন্ডে। সেখান থেকে সেই জল চলে যাচ্ছে পশ্চিম দিকে। জলে ঢাকা ছিল বলে নর্মদা স্নাত প্রথম শিবলিঙ্গ আমরা দেখতে পাই নি। এই এগার কোনা কুন্ডের পশ্চিম দিকে একটা ছোট্ট মন্দিরের মধ্যে রয়েছে মা নর্মদার একটি মূর্তি। উদ্গমের উত্তর দিকে মা নর্মদার মূল মন্দিরটি মোটামুটি বড়ই। এছাড়াও আরো অনেক মন্দির আছে এখানে। যেমন বেন্বেশ্বর মন্দির, একাদশ রুদ্র মন্দির, রাম মন্দির প্রভৃতি। সব মিলিয়ে সম্ভবত ২৭ টি মন্দির আছে এখানে - যার মধ্যে একটি অতি প্রাচীন, সম্ভবত কালচুরি রাজাদের আমলে তৈরী।


মন্দির ছাড়াও আরো একটা মজার জিনিষ আছে এখানে। একটা পাথরের হাতি। সকলেই দেখছি এই হাতির চার পায়ের ফাঁক দিয়ে গলে এদিক থেকে ওদিকে চলে যাচ্ছে। কি ব্যাপার খোঁজ নিয়ে জানলাম এটা মানুষের একটা বিশ্বাস যে পূণ্যবান লোকেরাই শুধু গলে যেতে পারবে - পাপীরা নয়। অন্য অনেকের সাথে শানু ও গলে গেল। তারপর ওর সে কি অনাবিল হাসি। আমি চেষ্টাই করলাম না। স্বেচ্ছায় পাপী রয়ে গেলাম।


সন্ধ্যা একটু ঘন হলে কোথা থেকে যেন অনেক লোক এসে উদ্গম মন্দিরে জড়ো হল। তারপর মা নর্মদার আরতি শুরু হল। আমরাও সামিল হলাম। অপূর্ব সব মন্ত্র এবং অপূর্ব তাদের সুর। আমি আগে কখনও শুনিনি এসব। মনটা খুব আনন্দ ও প্রশান্তি তে ভরে উঠলো। রোজকার কর্ম জীবনের পাপ ও তাপের বাইরে শান্তির ও যে একটা জগত আছে তা এখানে না এলে বোধহয় বুঝতেই পারতাম না।

সন্ধ্যারতি দর্শন করে তৃপ্ত মনে বাইরে বেরিয়ে এসে একটা গাড়ি ভাড়া করলাম কালকের সাইট সিইং এর জন্যে। তারপর হোটেলে ফিরে এসে এক কাপ চা খেয়ে ঘরের পিছনে বারান্দাটায় গিয়ে বসলাম। রাত আটটা বাজে। অমরকন্টকে এখন অপূর্ব এক নৈসর্গিক নিস্তব্ধতা। তার ওপর হোটেলের একটা বাড়ি পরেই মাঠের মধ্যে একটা পাকুড় গাছ আর একটা খেজুর গাছ একত্রে অত্যন্ত এক মোহময় পরিবেশ তৈরি করেছে। সেইদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আজ সন্ধ্যারতির সময় শোনা নর্মদাষ্টকম এর দু একটা স্লোক মনে করার চেষ্টা করলাম -

সবিন্দু সিন্ধু শুস্খলস্ তরঙ্গ ভঙ্গ রঞ্জিতম্
দ্বিষতসু পাপ তাপ জাত কারি বারি সংযুতম্ ।
কৃতান্তদূত কালভূত ভীতিহারী বর্মদে
ত্বদীয় পাদপঙ্কজং নমামি দেবি নর্মদে ।।
... ... ...

Please Subscribe and Share

Comments

Popular Posts